বাংলার খাবার বাংলার ঐতিহ্যেরই একটি অংশ। জিভে জল আসে যখন খাবারের তীব্র সুস্বাদু গন্ধটা নাকে আসতে থাকে। কি নেই বাঙালির খাবারে? টক থেকে মিষ্টি, গরু থেকে শুঁটকি, মাছ থেকে সবজি- সবই আছে। সারা বিশ্বের বিভিন্ন স্বাদের খাবারের অপূর্ব মিশ্রণ ঘটেছে এই বাঙালি খাবারের মধ্যে। আর বাঙালির খাবারের ইতিহাস পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত ইতিহাস।
বাংলার খাবার মূলত নানান ইতিহাসের সাক্ষী। বিশ্বের
নানা প্রান্তের সঙ্গে এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক ও দৃঢ় বাণিজ্যিক সম্পর্কের একটা সুস্পষ্ট
প্রভাব লক্ষ্য করা যায় এদেশের খাবারে। ১৩তম শতাব্দীর প্রথমদিকে বাংলায় শুরু হয় তুর্কীদের
শাসনামল। আর ১৮ ও ১৯ শতকে চলে বৃটিশদের দাপট। স্বভাবতই এদের খাবারের একটা প্রভাব পড়ে
বাঙালি খাবারের উপরে।
ইহুদীদের মাধ্যমে বেকারির সঙ্গে পরিচিত হয় এই
বাংলার মানুষ। মারওয়ারিরা শেখায় তাদের মিষ্টি তৈরির কৌশল, ওয়াজেদ আলী শাহ ও টিপু সুলতানের
পরিবার নিয়ে আসে হরেক রকমের মোঘলাই খাবারের স্বাদ। বৃটিশ পৃষ্ঠপোষকতা বাংলা অঞ্চলের
খাবারকে একটি ঐতিহ্যের পর্যায়ে পৌঁছে দেয়।
রান্নার দিক বিবেচনা করলে ঢাকার রান্নায় ছিলো
অনেকটা মোঘলদেরই ছোঁয়া। মোঘলাই খাবারের প্রধান আকর্ষণ ছিলো বিভিন্ন স্বাদের মসলা ও
মাংস। সেসময়ে গরুর মাংস ছিলো সবচাইতে প্রিয় খাবারের তালিকায়। অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ
আলী শাহ তার আমলে শ’খানেক বাবুর্চি, খানসামা ও মশ্লাচি নিয়ে বাংলায় আসেন। তাঁর মৃত্যুর
পর এই সকল লোক বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং এরা পরবর্তীতে বিভিন্ন খাবারের
দোকান চালু করে। তাদের খাবারে বিভিন্ন সুগন্ধীর ব্যবহার ছিলো চোখে পড়ার মতো।
বাংলার মানুষ প্রচণ্ডভাবে রসনাবিলাসী। আমরা খাবারের
পেছনে যত অর্থ ও শ্রম ব্যয় করি, পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলের মানুষ তা করেনা। আমাদের দেশে
একেক অঞ্চল মূলত একেক খাবারের জন্য বিখ্যাত। মিষ্টান্ন তৈরীতে বাঙালিএ প্রতিদ্বন্দী
বোধ করি আর কেউ হতে পারবেনা। আর বাংলাদেশের নানান অঞ্চলে নানান ধরণের মিষ্টি জাতীয়
খাবার প্রসিদ্ধ। যেমন বরিশালের গুঠিয়ার সন্দেশ, বগুড়ার দই, নাটোরের কাচাগোল্লা, কুমিল্লার
মাতৃভান্ডারের রসমালাই, মুক্তাগাছার মণ্ডা, টাঙ্গাইলের চমচম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামূখী
ইত্যাদি মিষ্টিজাতীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার এখন দেশের মানুষের কাছেতো আদরেরই, এখন সেটি বিদেশীদেরও
জিভে জল আনে।
বাঙালির একটি বিশেষ পরিচয় আছে, আর সেটি হলো “মাছে
ভাতে বাঙালি”। ভাত বাংলার মানুষের প্রধান খাবার হিসেবেই পরিচিত। আর নদীমাতৃক বাংলা
মাছের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখানে বিভিন্ন নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড় অঞ্চলে মাছ পাওয়া
যায় প্রচুর পরিমানে। বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলা ইলিশের উৎপাদনে বিখ্যাত। প্রচুর পরিমানে
ইলিশ এখন বিদেশে রপ্তানীও করা হচ্ছে। আর পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ বাঙালি সংস্কৃতির
একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়াও সিলেটের সাত লেয়ারের চা খুবই ঐতিহ্যবাহী
এবং পর্যটকদের জন্য আকর্ষনীয় খাবার। আর খাবারের প্রসঙ্গে পুরান ঢাকার জুড়ি মেলা ভার।
আদিকাল থেকেই ঢাকাবাসী ছিলো ভোজনরসিক। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবারের মধ্যে বাকরখানি
রুটি একটি প্রসিদ্ধ নাম। ঢাকার বাকরখানি সারাদেশে বিখ্যাত ছিলো। একসময়ে এই খাবার উপঢৌকন
হিসেবে পাঠানো হতো ভারতীয় উপমহাদেশের নানা অঞ্চলে। বর্তমানেও এর কদর কমেনি, বরং বেড়েছে।
রাজধানী ঢাকার চাঁনখারপুল পার হলেই নাজিমুদ্দীন রোড। এই এলাকার রাস্তার দুধারেই সারি
সারি বাকরখানির দোকান লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও সূত্রাপুর, লক্ষ্মীবাজার, গেণ্ডারিয়াসহ
পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এই খাবার পাওয়া যায়।
পুরান ঢাকার বিরিয়ানীর নাম ও স্বাদ লেগে থাকে
মানুষের মুখে। ঠিক কখন থেকে এ খাবারের আবির্ভাব হলো তার সঠিক হদিস না মিললেও এর জনপ্রিয়তা
শুরু হয়েছে মোঘল আমল থেকেই। পুরান ঢাকাতেই ভোজনরসিক মোঘলের বসবাস করতো, আর সেখান থেকেই
বাংলার মানুষের বিরিয়ানির প্রতি এত দূর্বলতা। পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারে হাজীর বিরিয়ানী,
নান্নার বিরিয়ানী, বুদ্দুর বিরিয়ানী এসবের নাম এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশী নাগরিকদের মুখে
ফোটে। এছাড়াও ঢাকাই খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কাবাব। বিভিন্ন ধরণের কাবাবের মধ্যে
টিক্কা, জালি কাবাব, কাঠি কাবাব, শাম্মি কাবাব, বটি কাবাব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও ভোজনরসিক বাঙালির পেটপূজা আর ভুরিভোজের
ক্ষেত্রে শীতকালীন বিভিন্ন পিঠা পায়েশ উল্লেখযোগ্য। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পাটিসাপটা,
নকশী পিঠা, ইত্যাদি নানান ধরণের পিঠাপুলির স্বাদ বাঙালির জন্য মুখরোচক হয়ে ধরা দেয়।
No comments:
Post a Comment