এককালে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিলো “ধানের দেশ, গানের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ”। গান বাজনা আমাদের সংস্কৃতির সাথেই মিশে আছে যুগ যুগ ধরে। রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল সংগীত, লালনগীতি ইত্যাদি ছাড়াও বাংলায় এক এক অঞ্চলে রয়েছে এক এক রকম ঐতিহ্যবাহী গান।
হাজার বছরের ঐতিহ্য ধারনকারী বাংলাদেশের সংস্কৃতির
সবচেয়ে বড় অংশ হচ্ছে লোকসংগীত। ঐতিহাসিক কাল থেকেই বাঙালি সংগীতপ্রিয় জাতি। বাস্তবে
এদেশের মানুষ যখন ভাষা পেয়েছে, তখন থেকেই লোকসংগীতের চল। ১১০০ বছর আগে রচিত চর্যাপদ
ছিলো বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন। চর্যাগুলো যে আঙ্গিকে ও ভাষায় লিপিবদ্ধ ছিলো, তাতে মোট ১৯ টির মতো রাগ-রাগিনী ছিলো। তার মধ্যে দুই চারটি লোকসঙ্গীতের সুর হতে পারে। ডাক
ও খনার বচনগুলোকে লোক সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন বলে ধরা হতো। এগুলোকেও সংগীতের আদি
ও অকৃত্রিম উৎস বলে দাবি করেছেন কেউ কেউ। যদিও লোকসংগীতের প্রাচীন নমুনা উদ্ধার করা
যায়নি, তবে কীর্তন, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, বারমাসী, ঝুমুর, ব্রত প্রভৃতি গানের নাম
পাওয়া গেছে মধ্যযুগের একাধিক কাব্যে। মঙ্গলকাব্যের বারোমাসী বিষয় ও ফর্ম সরাসরি লৌকিক
বারোমাসী থেকেই সংগৃহীত। চর্যাপদে, কৃষ্ণকথায়, মনসামঙ্গলে , দেহতত্ত্বের গানে নদী ও
নৌকার প্রসঙ্গ নানাভাবে এসেছে। নৌকার শ্রমজীবী গাবরদের এ সারিগান নিঃসন্দেহে লোকসংগীত
ছিলো। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন নিদর্শন এদেশের গানের উৎস হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত “বাংলাদেশ
সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-৭”- এর বর্ণনা থেকে লোকসংগীতের নিম্নরূপ বিষয়ভিত্তিক একটি শ্রেণীবিভাগ
পাওয়া যায়-
১) ধর্ম,
তত্ত্ব, ভক্তি, আচার ও সংস্কার: অষ্টক গান, কীর্তন, গাজন, জাগ গান, জারি গান,
ধামাইল গান, ধুয়া গান, নৈলার গান, বাউল গান, বিচার গান, ভাটিয়ালি গান, মনসা ভাসান বা
রয়ানি গান, মর্সিয়া গান, মাইজভান্ডারি গান, মারফতি গান, মুর্শিদি গান, হুদমার গীত,
উরি বা হোলির গান।
২)
প্রেম ও বিনোদন: আলকাপ গান, গোসা গান, ঘাটু গান, বারোমাসী, বারাষে, বিচ্ছেদি গান,
ভাওয়াইয়া, সারি গান।
৩)
কর্ম ও শ্রম: ক্ষেত নিড়ানির গান, ধান ও পাট কাটার গান, ধান ভানার গীত, হাতি
খেদানোর গান।
৪)
পেশা ও বৃত্তি: খেমটা গান, পটুয়া সংগীত, পালকিওয়ালার গান, ফেরিওয়ালার গান, বেদে
বা সাপুড়ের গান, বাওয়ালির গান, পুতুলনাচের গান।
৫)
হাস্য-কৌতুক: গম্ভীরা গান, চটকা গান, হাবু গান।
৬)
মিশ্র ভাব-বিষয়: কবিগান, নাটুয়া গান, মেয়েলি গীত।
এবারে কিছু উল্লেখযোগ্য গান নিয়ে আলোচনা করবো।
জারি:
জারিগান
ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে অধিক গাওয়া হয়। জারি শব্দটির অর্থ বিলাপ বা ক্রন্দন। বাংলাদেশে
মহররমের বিশেষ দিনে কারবালার শোকাবহ ঘটনা অবলম্বনে নৃত্যগীত সমন্বয়ে যে কাহিনী পরিবেশিত
হয় সেটিই জারিগান নামে পরিচিত। এছাড়া যেকোন ধর্মীয়, রূপকথার গল্প, অতিলৌকিক বা সামাজিক
বিষয় নিয়ে রচিত গানকে কখনো কখনো জারিগান নামে অভিহিত করা হয়।
সারি:
নৌকাবাইচ
প্রতিযোগীতায় এই গান গাওয়া হয়।
ভাটিয়ালি:
বাংলাদেশের
ভাটি অঞ্চলের জনপ্রিয় গান। বিশেষ করে নদ-নদীপূর্ণ ময়মনসিংহ অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র নদের
উত্তর-পূর্ব দিকের অঞ্চলগুলোতেই ভাটিয়ালি গানের মূল সৃষ্টি। এ গানগুলো রচিত হয় মূলত
মাঝি, নৌকা, দাড় গুন ইত্যাদি বিষয়ে। সাথে থাকে গ্রামীণ জীবন, গ্রামীণ নারীর প্রেম ভালোবাসা,
বিরহ, আকুলতা ইত্যাদির সম্মিলন।
ভাওয়াইয়া:
ভাওয়াইয়া
মূলত বাংলাদেশের রংপুর এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে ও আসামের গোয়ালপাড়ায় প্রচলিত
এক প্রকার পল্লীগীতি। এগানে স্থানীয় জনপদের জীবনযাত্রা, কর্মক্ষেত্র এবং পারিবারিক
ঘটনাবলির সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে।
পালা:
সিলেট,
কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণার হাওড় অঞ্চলের গান। এই গান দুই পক্ষের প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে
গাওয়া হয়।
গম্ভীরা:
বাংলার
লোকসংগীতের অন্যতম একটি ধারা। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও পশ্চিমবঙ্গের মালদহ অঞ্চলে
গম্ভীরার প্রচলন রয়েছে। গম্ভীরা দলবদ্ধভাবে গাওয়া হয়। এটি বর্ণনামূলক গান। চাঁপাইনবাবগঞ্জে
গম্ভীরার মুখ্য চরিত্রে নানা-নাতি খুব জনপ্রিয়।। ধারণা করা হয় এর উদ্ভব হয়েছে শিবপূজাকে
কেন্দ্র করে। কারণ শিবের অন্য নাম “গম্ভীর”। শিবের উৎসব গম্ভীরা উৎসব, তাই তাঁর বন্দনাগীতি
গম্ভীরা গান।
কীর্তন:
রাধা-কৃষ্ণের
প্রেম-বিরহ নিয়ে হিন্দু সমাজের গান।
বাউল
গান: লালন ফকির, শাহ আবদুল করিম বাউল গানে অগ্রগণ্য।
বাংলার ঐতিহ্যবাহী এসব গান আজ পড়ে যাচ্ছে হুমকির
মুখে। এসবের জায়গায় এখন চর্চা করা হচ্ছে পাশ্চাত্য ধারার গানগুলো। গান মাত্রই সংস্কৃতির
ধারক। সব ধরণের সুস্থ ধারার গানই প্রশংসার যোগ্য, কিন্তু আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ধারক
ও বাহক এই গানগুলোর চর্চা বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যাবে।
জাতি হিসেবে আমাদের গর্বের জায়গাগুলো হারাবে তাদের স্থান। যেটা মোটেও কাম্য নয়।
No comments:
Post a Comment