Thursday, April 19, 2018

গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলা; পৌঁছেছে বিলুপ্তির দোরগোড়ায়


বেশি আগের কথা না। হবে ষোল কি সতেরো বছর আগে। গ্রামের সব ঘরে তখন বিদ্যুতের আলোও পোঁছায়নি। ইট-কংক্রিটের গাঁথুনিতে তখনও কাচা রাস্তা পাকা হয়ে ওঠেনি। দশ বিশ ঘর ঘুরে তখন একটা সাদাকালো টেলিভিশন পাওয়াও ছিলো মুশকিল। অসংখ্য খাল আর বিস্তৃত বিল আবহমান বাংলার পরিচয়ে তখন সমৃদ্ধ। বিকেল হলেই উঠানে কিংবা মহল্লায় জমতো বিভিন্ন খেলার আসর। ছিলো ঋতু অনুযায়ী খেলা। বর্ষাকালে হাডুডু, ফুটবল, লুডো আবার শীতকালে রোদ পোহাতে বসে ষোল গুটি, তিন গুটি। বাড়ির উঠান ভরে উঠতো শিশু কিশোরদের হৈ হুল্লোড়ে। কানামাছি, কুতকুত, বউছি, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা ইত্যাদি খেলা হতো। বরফ পানি, মারবেল, লাটিম, মোরগ লড়াই, সাত চাড়া, ডাংগুলির কদর ছিলো বেশি। কিন্তু কালের বিবর্তনে এসব খেলা আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এসব খেলাধূলা আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। লাঠি খেলা, ষাঁড় দৌড় প্রবীণদের স্মৃতিতে এখনো দাগ কেটে বেড়ায়। মনে করিয়ে দেয় আগেকার সুন্দর দিনগুলোর কথা।

কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ; ওপেন্টি বায়োস্কোপ, নাইন টেন টেইস্কোপ, চুলটানা বিবিয়ানা সাহেব বাবুর বৈঠকখানা…ইচিং বিচিং চিচিং চা, প্রজাপতি উড়ে যা… এমন হরেক রকম কথায় খেলায় মেতে উঠতো গ্রাম বাংলার শিশু কিশোরেরা। কিন্তু সময়ের খড়গে আজ খেলা বিপন্নের পাশাপাশি হারিয়ে গিয়েছে এইসব কবিতা বা ছড়ার মাধ্যমে বলা কথাগুলো। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এসব ছড়া এখন একেবারেই অপরিচিত। বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যে খেলাধুলার ইতিহাস হাজার বছরের প্রাচীন এবং পুরানো। গ্রামকে বলা হয় বাংলার হৃদপিন্ড। এককালে গ্রামে যেসব খেলাধূলা শিশু-যুবক-কিশোরেরা খেলতো হরদম, খেলাধুলার আবেশে মাতিয়ে রাখতো বাড়ির উঠান, স্কুলের মাঠ, ফসলবিহীন ক্ষেত; বর্তমানে এসে সেসব খেলা হারাতে বসেছে পল্লীগ্রামের আনাচে কানাচে থেকে। খেলাধুলাতে কোনকালেই পিছিয়ে থাকেনি বাঙালিরা। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের কিশোরেরা। খেলার চেয়ে ধুলাবালি কাদা মাখানোর পালাটাই যদিও বেশিই থাকতো। দস্যি ছেলেরা মায়ের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই ছুটতো মাঠে। এই ছুটে চলা যেন ছিলো চিরন্তন। যারা একটু ছোট ছিলো, তাদের ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলা ছিলো একটু ভিন্ন ধরনের। কিশোরদের ফুটবল হিসেবে কখনো কখনো ব্যবহার করা হতো চালতার কড়ি, কখনোওবা গাছ থেকে ঝরে পড়া জাম্বুরা। তবুও তাদের উৎসাহে ভাটা পড়েনি কখনো। দাঁড়িয়াবান্ধা ছিলো গ্রামের লোকদের একটি চমকপ্রদ খেলা। দাগের দুপাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতো মানুষ। মারবেল আর ডাঙ্গুলি খেলা হতো শরত, শীত ও গ্রীষ্মকালে। যদিও অভিভাবকদের কাছে এই খেলাগুলো খানিকটা বাজে এবং বিপজ্জনক খেলা হিসেবে মনে হতো।


আধুনিক ও ডিজিটাল যুগে এসে হারিয়ে গিয়েছে এসব খেলা। যেখানে শারীরিক শ্রমের মাধ্যমে এই খেলাগুলো শিশু কিশোরদের নানান কাজের প্রতি উৎসাহের যোগান দিত, সেখানে এসব খেলা আজ কম্পিউটার গেমস, ইন্টারনেটের মতো আধুনিক ডিভাইসের কাছে হার মেনেছে। আজকালকার যুগের শিশুরা ইন্টারনেটে ফেসবুকসহ আসক্ত হয়ে পড়ছে নানান প্রযুক্তির প্রতি। ফলে শারীরিক শ্রমের মতো বিনোদনগুলো ঠাঁই পাচ্ছেনা আধুনিক সমাজে। ফলে বর্তমান প্রজন্মের যথাযথ মানসিক বিকাশ ঘটছে না। বাড়ছে নানান ধরণের রোগব্যধির সংখ্যা। তাই বর্তমান প্রজন্মের স্বার্থেই গ্রামীণ খেলাধুলাগুলো ফিরিয়ে এনে তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোর সাথে। আগামী প্রজন্মের চোখে থাকুক মুক্ত আকাশ, নিঃশ্বাসে থাকুক বিশুদ্ধ বাতাস, বিনোদনে থাকুক আমাদেরই ঐতিহ্যগুলো- এমনটাই এখন সময়ের প্রত্যাশা।

No comments:

Post a Comment

পোশাকে-আশাকে বাঙালির ঐতিহ্য

আমরা যখন কোনো বাঙালি নারীর কথা চিন্তা করি, তখনই আমাদের সামনে যে অবয়বটি ফুটে উঠে, সেটি হলো শাড়ি পরা এক নারীর চিত্র। রকমারি মুখরোচক খাবার...