Friday, April 20, 2018

পোশাকে-আশাকে বাঙালির ঐতিহ্য


আমরা যখন কোনো বাঙালি নারীর কথা চিন্তা করি, তখনই আমাদের সামনে যে অবয়বটি ফুটে উঠে, সেটি হলো শাড়ি পরা এক নারীর চিত্র। রকমারি মুখরোচক খাবারের পর যে বৈশিষ্ট্যটি বাঙালির পরিচয় বহন করে, সেটি হলো বাঙালির পোশাক। আর পোশাক বলতেই বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচয়বাহক শাড়ি এবং পাঞ্জাবির কথা মনে পড়ে যায়।

বাঙালি রমনীদের শাড়ি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। সাদা শাড়ি লাল পাড় শুধু বাংলার ঐতিহ্যবাহী পোশাকই নয়, এটি বাংলার নারীদের অহংকারের একটা জায়গা। আর বাংলার শাড়ির ঐতিহ্যে মসলিন আর জামদানী এই দুইটি নাম উল্লেখ না করলেই নয়।

বাংলাদেশের সুপ্রাচীনকালের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের গৌরবময় স্মারক হলো মসলিন। “পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রিয়ান সি” শীর্ষক গ্রন্থে মসলিন সম্পর্কে বিশেষ ধরণের তথ্য পাওয়া যায়। মসলিনকে মোনাচি এবং সর্বোৎকৃষ্ট মসলিনকে গেঞ্জেটিক বা গঙ্গাজলি বলে।
মসলিনের সুক্ষ্মতার কথা ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা থেকে জানা যায়। বাংলাদেশের মসলিন বস্ত্রের সুক্ষ্মতা ও সৌন্দর্য বহু বিদেশী পর্যটককে মুগ্ধ করেছে। মসলিন কাপড়ের সুক্ষ্মতা এতই বেশি ছিলো যে একটা আংটির মধ্যে দিয়ে ৪০ হাত লম্বা দুই হাত চওড়া মসলিন কাপড় সহজেই চালাচালি করা যেতো। মসলিন তাঁতীরা মূলত সোনারগাঁও অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। গবেষকদের মতে মসলিন তৈরির প্রাচীনতম কেন্দ্র ছিলো অধুনা ভাওয়াল জঙ্গলে পরিবেষ্টিত কাপাসিয়া। ঢাকা, সোনারগাঁও, ডেমরা, তিতবন্ধী, বালিয়াপাড়া, নাপাড়া, মৈকুলি, নবীগঞ্জ, ধামরাই, সিদ্ধিপুর, কাঁচপুর প্রভৃতি জায়গায় মসলিন তৈরির প্রধান কেন্দ্র ছিলো। মসলিন তৈরীর জন্য প্রয়োজন হতো বিশেষ ধরণের সুক্ষ্ম সুতা যা অন্য কোথাও থেকে আমদানী করা হতো না। বরং বাংলাদেশের মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বয়রাতি ও ফুটি কার্পাসের আবাদ করা হতো। সেই কার্পাসের তুলা থেকে ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়েসী মেয়েরা আঙ্গুলের সাহায্যে মিহি সুতা তৈরি করতো। এরপর ধাপে ধাপে তৈরি হতো মসলিন কাপড়।

মসলিন কাপড়ের বিলুপ্তির সাথে সাথে তার উত্তরাধিকার হিসেবে জায়গা দখল করে নিলো ঢাকাই জামদানী। মসলিনের উপর প্রথমে নকশা করেই জামদানী শাড়ি তৈরী করা হতো। বর্তমানে ঢাকার মিরপুরে জামদানী পল্লী স্থাপিত হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জামদানী শাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এখনো। বর্তমান বাজারে জামদানির উচ্চমূল্য ও বিপুল চাহিদার কারণে বাংলাদেশে এই জামদানি শিল্প নতুন গতির সঞ্চার করেছে।

এছাড়াও টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি, মনিপুরী তাঁত বিশেষভাবে সমাদৃত। অপরদিকে রাজশাহী সিল্কের শাড়ি বাংলার পোশাকের ঐতিহ্য ধারণে এক নতুন মাত্রার সৃষ্টি করেছে।

অন্যদিকে বাঙালি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের জায়গা যুগ যুগ ধরে দখল করে আছে পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি। আগে পুরুষেরা একটু ঢিলেঢালা হাঁটু সমান লম্বা সিল্কের পাঞ্জাবি পরতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। তবে এখন পাঞ্জাবিতে একটু বৈচিত্র্যের ছোঁয়া লক্ষ্য করা যায়।
অন্যদিকে লুঙ্গিও আমাদের জাতীয় পোশাকের মধ্যে অন্যতম। সুতি, সিল্ক কিংবা বাটিকের কাপড়ের তৈরি লুঙ্গি পরতে বেশ আরামদায়ক। এছাড়াও ধুতিও বাঙ্গালিয়ানা ঐতিহ্যধারনকারী একটি পোশাক।
বাংলার ঐতিহ্যবাহী পোশাকের ডিজাইনের সাথে ঐতিহ্যবাহী নকশী কাঁথার মেলবন্ধন দেখা যায়। তবে বাংলার তাঁতীরা মূলত নকশী কাঁথায় সুঁইয়ের ফোঁড়ের মাধ্যমে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য তুলে ধরতেন। এই কাঁথা বানানোর পেছনে প্রয়োজন সুনিপুণ দক্ষতা এবং গভীর মনোযোগ।

যুগ যুগ ধরে চলে আসা ঐতিহ্যকে ছাপিয়ে বাঙালিদের পোশাকে বেশ পরিবর্তন এনেছে আরামদায়ক এবং স্বাচ্ছন্দ্যবোধ ব্যাপারটি। বাঙালিরা এখন চলতে ফিরতে ঐতিহ্য থেকেও বেশি গুরুত্ব দেয় আরামের দিকটিকে। মহিলারা এখন সালোয়ার কামিজ এবং সুতি শাড়ি পরতে বেশি পছন্দ করে। অন্যদিকে পুরুষের পোশাকেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। লুঙ্গি বা পাঞ্জাবির পরিবর্তে এখন গোলগলা টি-শার্ট, শার্ট, ফতুয়া, পায়জামা, জিন্স প্যান্ট ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।


ঋতুভেদে বাংলার মানুষ নানান ধরণের পোশাক পরিধান করলেও, কিংবা যেকোন সময়ে সুবিধামত পোশাক পরলেও ঐতিহ্যবাহী পোশাকের এই রীতি ঐতিহ্যবাহী অথবা ধর্মীয় ধর্মীয় কোনো উপলক্ষে এখনো বেশ প্রাধান্য পায়। যার প্রতিফলন আমরা বিয়ে, ফাল্গুন, পহেলা বৈশাখ, অথবা দূর্গাপূজায় দেখতে পাই।

ভোজনরসিকতা; মিশে আছে বাঙালির পরিচয়ের সাথে


বাংলার খাবার বাংলার ঐতিহ্যেরই একটি অংশ। জিভে জল আসে যখন খাবারের তীব্র সুস্বাদু গন্ধটা নাকে আসতে থাকে। কি নেই বাঙালির খাবারে? টক থেকে মিষ্টি, গরু থেকে শুঁটকি, মাছ থেকে সবজি- সবই আছে। সারা বিশ্বের বিভিন্ন স্বাদের খাবারের অপূর্ব মিশ্রণ ঘটেছে এই বাঙালি খাবারের মধ্যে। আর বাঙালির খাবারের ইতিহাস পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত ইতিহাস।

বাংলার খাবার মূলত নানান ইতিহাসের সাক্ষী। বিশ্বের নানা প্রান্তের সঙ্গে এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক ও দৃঢ় বাণিজ্যিক সম্পর্কের একটা সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায় এদেশের খাবারে। ১৩তম শতাব্দীর প্রথমদিকে বাংলায় শুরু হয় তুর্কীদের শাসনামল। আর ১৮ ও ১৯ শতকে চলে বৃটিশদের দাপট। স্বভাবতই এদের খাবারের একটা প্রভাব পড়ে বাঙালি খাবারের উপরে।

ইহুদীদের মাধ্যমে বেকারির সঙ্গে পরিচিত হয় এই বাংলার মানুষ। মারওয়ারিরা শেখায় তাদের মিষ্টি তৈরির কৌশল, ওয়াজেদ আলী শাহ ও টিপু সুলতানের পরিবার নিয়ে আসে হরেক রকমের মোঘলাই খাবারের স্বাদ। বৃটিশ পৃষ্ঠপোষকতা বাংলা অঞ্চলের খাবারকে একটি ঐতিহ্যের পর্যায়ে পৌঁছে দেয়।
রান্নার দিক বিবেচনা করলে ঢাকার রান্নায় ছিলো অনেকটা মোঘলদেরই ছোঁয়া। মোঘলাই খাবারের প্রধান আকর্ষণ ছিলো বিভিন্ন স্বাদের মসলা ও মাংস। সেসময়ে গরুর মাংস ছিলো সবচাইতে প্রিয় খাবারের তালিকায়। অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ তার আমলে শ’খানেক বাবুর্চি, খানসামা ও মশ্লাচি নিয়ে বাংলায় আসেন। তাঁর মৃত্যুর পর এই সকল লোক বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং এরা পরবর্তীতে বিভিন্ন খাবারের দোকান চালু করে। তাদের খাবারে বিভিন্ন সুগন্ধীর ব্যবহার ছিলো চোখে পড়ার মতো।

বাংলার মানুষ প্রচণ্ডভাবে রসনাবিলাসী। আমরা খাবারের পেছনে যত অর্থ ও শ্রম ব্যয় করি, পৃথিবীর আর কোনো অঞ্চলের মানুষ তা করেনা। আমাদের দেশে একেক অঞ্চল মূলত একেক খাবারের জন্য বিখ্যাত। মিষ্টান্ন তৈরীতে বাঙালিএ প্রতিদ্বন্দী বোধ করি আর কেউ হতে পারবেনা। আর বাংলাদেশের নানান অঞ্চলে নানান ধরণের মিষ্টি জাতীয় খাবার প্রসিদ্ধ। যেমন বরিশালের গুঠিয়ার সন্দেশ, বগুড়ার দই, নাটোরের কাচাগোল্লা, কুমিল্লার মাতৃভান্ডারের রসমালাই, মুক্তাগাছার মণ্ডা, টাঙ্গাইলের চমচম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামূখী ইত্যাদি মিষ্টিজাতীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার এখন দেশের মানুষের কাছেতো আদরেরই, এখন সেটি বিদেশীদেরও জিভে জল আনে।

বাঙালির একটি বিশেষ পরিচয় আছে, আর সেটি হলো “মাছে ভাতে বাঙালি”। ভাত বাংলার মানুষের প্রধান খাবার হিসেবেই পরিচিত। আর নদীমাতৃক বাংলা মাছের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখানে বিভিন্ন নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড় অঞ্চলে মাছ পাওয়া যায় প্রচুর পরিমানে। বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলা ইলিশের উৎপাদনে বিখ্যাত। প্রচুর পরিমানে ইলিশ এখন বিদেশে রপ্তানীও করা হচ্ছে। আর পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ বাঙালি সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়াও সিলেটের সাত লেয়ারের চা খুবই ঐতিহ্যবাহী এবং পর্যটকদের জন্য আকর্ষনীয় খাবার। আর খাবারের প্রসঙ্গে পুরান ঢাকার জুড়ি মেলা ভার। আদিকাল থেকেই ঢাকাবাসী ছিলো ভোজনরসিক। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবারের মধ্যে বাকরখানি রুটি একটি প্রসিদ্ধ নাম। ঢাকার বাকরখানি সারাদেশে বিখ্যাত ছিলো। একসময়ে এই খাবার উপঢৌকন হিসেবে পাঠানো হতো ভারতীয় উপমহাদেশের নানা অঞ্চলে। বর্তমানেও এর কদর কমেনি, বরং বেড়েছে। রাজধানী ঢাকার চাঁনখারপুল পার হলেই নাজিমুদ্দীন রোড। এই এলাকার রাস্তার দুধারেই সারি সারি বাকরখানির দোকান লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও সূত্রাপুর, লক্ষ্মীবাজার, গেণ্ডারিয়াসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এই খাবার পাওয়া যায়।
পুরান ঢাকার বিরিয়ানীর নাম ও স্বাদ লেগে থাকে মানুষের মুখে। ঠিক কখন থেকে এ খাবারের আবির্ভাব হলো তার সঠিক হদিস না মিললেও এর জনপ্রিয়তা শুরু হয়েছে মোঘল আমল থেকেই। পুরান ঢাকাতেই ভোজনরসিক মোঘলের বসবাস করতো, আর সেখান থেকেই বাংলার মানুষের বিরিয়ানির প্রতি এত দূর্বলতা। পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারে হাজীর বিরিয়ানী, নান্নার বিরিয়ানী, বুদ্দুর বিরিয়ানী এসবের নাম এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশী নাগরিকদের মুখে ফোটে। এছাড়াও ঢাকাই খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কাবাব। বিভিন্ন ধরণের কাবাবের মধ্যে টিক্কা, জালি কাবাব, কাঠি কাবাব, শাম্মি কাবাব, বটি কাবাব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।


এছাড়াও ভোজনরসিক বাঙালির পেটপূজা আর ভুরিভোজের ক্ষেত্রে শীতকালীন বিভিন্ন পিঠা পায়েশ উল্লেখযোগ্য। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পাটিসাপটা, নকশী পিঠা, ইত্যাদি নানান ধরণের পিঠাপুলির স্বাদ বাঙালির জন্য মুখরোচক হয়ে ধরা দেয়।

বাংলার গান; গানের বাংলা


এককালে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিলো “ধানের দেশ, গানের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ”। গান বাজনা আমাদের সংস্কৃতির সাথেই মিশে আছে যুগ যুগ ধরে। রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল সংগীত, লালনগীতি ইত্যাদি ছাড়াও বাংলায় এক এক অঞ্চলে রয়েছে এক এক রকম ঐতিহ্যবাহী গান।

হাজার বছরের ঐতিহ্য ধারনকারী বাংলাদেশের সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় অংশ হচ্ছে লোকসংগীত। ঐতিহাসিক কাল থেকেই বাঙালি সংগীতপ্রিয় জাতি। বাস্তবে এদেশের মানুষ যখন ভাষা পেয়েছে, তখন থেকেই লোকসংগীতের চল। ১১০০ বছর আগে রচিত চর্যাপদ ছিলো বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন। চর্যাগুলো যে আঙ্গিকে ও ভাষায় লিপিবদ্ধ ছিলো, তাতে মোট ১৯ টির মতো রাগ-রাগিনী ছিলো। তার মধ্যে দুই চারটি লোকসঙ্গীতের সুর হতে পারে। ডাক ও খনার বচনগুলোকে লোক সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন বলে ধরা হতো। এগুলোকেও সংগীতের আদি ও অকৃত্রিম উৎস বলে দাবি করেছেন কেউ কেউ। যদিও লোকসংগীতের প্রাচীন নমুনা উদ্ধার করা যায়নি, তবে কীর্তন, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, বারমাসী, ঝুমুর, ব্রত প্রভৃতি গানের নাম পাওয়া গেছে মধ্যযুগের একাধিক কাব্যে। মঙ্গলকাব্যের বারোমাসী বিষয় ও ফর্ম সরাসরি লৌকিক বারোমাসী থেকেই সংগৃহীত। চর্যাপদে, কৃষ্ণকথায়, মনসামঙ্গলে , দেহতত্ত্বের গানে নদী ও নৌকার প্রসঙ্গ নানাভাবে এসেছে। নৌকার শ্রমজীবী গাবরদের এ সারিগান নিঃসন্দেহে লোকসংগীত ছিলো। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন নিদর্শন এদেশের গানের উৎস হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে।


বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত “বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা-৭”- এর বর্ণনা থেকে লোকসংগীতের নিম্নরূপ বিষয়ভিত্তিক একটি শ্রেণীবিভাগ পাওয়া যায়-

১) ধর্ম, তত্ত্ব, ভক্তি, আচার ও সংস্কার: অষ্টক গান, কীর্তন, গাজন, জাগ গান, জারি গান, ধামাইল গান, ধুয়া গান, নৈলার গান, বাউল গান, বিচার গান, ভাটিয়ালি গান, মনসা ভাসান বা রয়ানি গান, মর্সিয়া গান, মাইজভান্ডারি গান, মারফতি গান, মুর্শিদি গান, হুদমার গীত, উরি বা হোলির গান। 

২) প্রেম ও বিনোদন: আলকাপ গান, গোসা গান, ঘাটু গান, বারোমাসী, বারাষে, বিচ্ছেদি গান, ভাওয়াইয়া, সারি গান।

৩) কর্ম ও শ্রম: ক্ষেত নিড়ানির গান, ধান ও পাট কাটার গান, ধান ভানার গীত, হাতি খেদানোর গান।

৪) পেশা ও বৃত্তি: খেমটা গান, পটুয়া সংগীত, পালকিওয়ালার গান, ফেরিওয়ালার গান, বেদে বা সাপুড়ের গান, বাওয়ালির গান, পুতুলনাচের গান।

৫) হাস্য-কৌতুক: গম্ভীরা গান, চটকা গান, হাবু গান।

৬) মিশ্র ভাব-বিষয়: কবিগান, নাটুয়া গান, মেয়েলি গীত।

এবারে কিছু উল্লেখযোগ্য গান নিয়ে আলোচনা করবো।
জারি: জারিগান ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে অধিক গাওয়া হয়। জারি শব্দটির অর্থ বিলাপ বা ক্রন্দন। বাংলাদেশে মহররমের বিশেষ দিনে কারবালার শোকাবহ ঘটনা অবলম্বনে নৃত্যগীত সমন্বয়ে যে কাহিনী পরিবেশিত হয় সেটিই জারিগান নামে পরিচিত। এছাড়া যেকোন ধর্মীয়, রূপকথার গল্প, অতিলৌকিক বা সামাজিক বিষয় নিয়ে রচিত গানকে কখনো কখনো জারিগান নামে অভিহিত করা হয়।

সারি: নৌকাবাইচ প্রতিযোগীতায় এই গান গাওয়া হয়।

ভাটিয়ালি: বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের জনপ্রিয় গান। বিশেষ করে নদ-নদীপূর্ণ ময়মনসিংহ অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর-পূর্ব দিকের অঞ্চলগুলোতেই ভাটিয়ালি গানের মূল সৃষ্টি। এ গানগুলো রচিত হয় মূলত মাঝি, নৌকা, দাড় গুন ইত্যাদি বিষয়ে। সাথে থাকে গ্রামীণ জীবন, গ্রামীণ নারীর প্রেম ভালোবাসা, বিরহ, আকুলতা ইত্যাদির সম্মিলন।

ভাওয়াইয়া: ভাওয়াইয়া মূলত বাংলাদেশের রংপুর এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে ও আসামের গোয়ালপাড়ায় প্রচলিত এক প্রকার পল্লীগীতি। এগানে স্থানীয় জনপদের জীবনযাত্রা, কর্মক্ষেত্র এবং পারিবারিক ঘটনাবলির সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে।

পালা: সিলেট, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণার হাওড় অঞ্চলের গান। এই গান দুই পক্ষের প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে গাওয়া হয়।

গম্ভীরা: বাংলার লোকসংগীতের অন্যতম একটি ধারা। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও পশ্চিমবঙ্গের মালদহ অঞ্চলে গম্ভীরার প্রচলন রয়েছে। গম্ভীরা দলবদ্ধভাবে গাওয়া হয়। এটি বর্ণনামূলক গান। চাঁপাইনবাবগঞ্জে গম্ভীরার মুখ্য চরিত্রে নানা-নাতি খুব জনপ্রিয়।। ধারণা করা হয় এর উদ্ভব হয়েছে শিবপূজাকে কেন্দ্র করে। কারণ শিবের অন্য নাম “গম্ভীর”। শিবের উৎসব গম্ভীরা উৎসব, তাই তাঁর বন্দনাগীতি গম্ভীরা গান।

কীর্তন: রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-বিরহ নিয়ে হিন্দু সমাজের গান।

বাউল গান: লালন ফকির, শাহ আবদুল করিম বাউল গানে অগ্রগণ্য।



বাংলার ঐতিহ্যবাহী এসব গান আজ পড়ে যাচ্ছে হুমকির মুখে। এসবের জায়গায় এখন চর্চা করা হচ্ছে পাশ্চাত্য ধারার গানগুলো। গান মাত্রই সংস্কৃতির ধারক। সব ধরণের সুস্থ ধারার গানই প্রশংসার যোগ্য, কিন্তু আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এই গানগুলোর চর্চা বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যাবে। জাতি হিসেবে আমাদের গর্বের জায়গাগুলো হারাবে তাদের স্থান। যেটা মোটেও কাম্য নয়।

Thursday, April 19, 2018

গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলা; পৌঁছেছে বিলুপ্তির দোরগোড়ায়


বেশি আগের কথা না। হবে ষোল কি সতেরো বছর আগে। গ্রামের সব ঘরে তখন বিদ্যুতের আলোও পোঁছায়নি। ইট-কংক্রিটের গাঁথুনিতে তখনও কাচা রাস্তা পাকা হয়ে ওঠেনি। দশ বিশ ঘর ঘুরে তখন একটা সাদাকালো টেলিভিশন পাওয়াও ছিলো মুশকিল। অসংখ্য খাল আর বিস্তৃত বিল আবহমান বাংলার পরিচয়ে তখন সমৃদ্ধ। বিকেল হলেই উঠানে কিংবা মহল্লায় জমতো বিভিন্ন খেলার আসর। ছিলো ঋতু অনুযায়ী খেলা। বর্ষাকালে হাডুডু, ফুটবল, লুডো আবার শীতকালে রোদ পোহাতে বসে ষোল গুটি, তিন গুটি। বাড়ির উঠান ভরে উঠতো শিশু কিশোরদের হৈ হুল্লোড়ে। কানামাছি, কুতকুত, বউছি, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা ইত্যাদি খেলা হতো। বরফ পানি, মারবেল, লাটিম, মোরগ লড়াই, সাত চাড়া, ডাংগুলির কদর ছিলো বেশি। কিন্তু কালের বিবর্তনে এসব খেলা আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এসব খেলাধূলা আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। লাঠি খেলা, ষাঁড় দৌড় প্রবীণদের স্মৃতিতে এখনো দাগ কেটে বেড়ায়। মনে করিয়ে দেয় আগেকার সুন্দর দিনগুলোর কথা।

কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ; ওপেন্টি বায়োস্কোপ, নাইন টেন টেইস্কোপ, চুলটানা বিবিয়ানা সাহেব বাবুর বৈঠকখানা…ইচিং বিচিং চিচিং চা, প্রজাপতি উড়ে যা… এমন হরেক রকম কথায় খেলায় মেতে উঠতো গ্রাম বাংলার শিশু কিশোরেরা। কিন্তু সময়ের খড়গে আজ খেলা বিপন্নের পাশাপাশি হারিয়ে গিয়েছে এইসব কবিতা বা ছড়ার মাধ্যমে বলা কথাগুলো। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এসব ছড়া এখন একেবারেই অপরিচিত। বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যে খেলাধুলার ইতিহাস হাজার বছরের প্রাচীন এবং পুরানো। গ্রামকে বলা হয় বাংলার হৃদপিন্ড। এককালে গ্রামে যেসব খেলাধূলা শিশু-যুবক-কিশোরেরা খেলতো হরদম, খেলাধুলার আবেশে মাতিয়ে রাখতো বাড়ির উঠান, স্কুলের মাঠ, ফসলবিহীন ক্ষেত; বর্তমানে এসে সেসব খেলা হারাতে বসেছে পল্লীগ্রামের আনাচে কানাচে থেকে। খেলাধুলাতে কোনকালেই পিছিয়ে থাকেনি বাঙালিরা। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের কিশোরেরা। খেলার চেয়ে ধুলাবালি কাদা মাখানোর পালাটাই যদিও বেশিই থাকতো। দস্যি ছেলেরা মায়ের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই ছুটতো মাঠে। এই ছুটে চলা যেন ছিলো চিরন্তন। যারা একটু ছোট ছিলো, তাদের ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলা ছিলো একটু ভিন্ন ধরনের। কিশোরদের ফুটবল হিসেবে কখনো কখনো ব্যবহার করা হতো চালতার কড়ি, কখনোওবা গাছ থেকে ঝরে পড়া জাম্বুরা। তবুও তাদের উৎসাহে ভাটা পড়েনি কখনো। দাঁড়িয়াবান্ধা ছিলো গ্রামের লোকদের একটি চমকপ্রদ খেলা। দাগের দুপাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতো মানুষ। মারবেল আর ডাঙ্গুলি খেলা হতো শরত, শীত ও গ্রীষ্মকালে। যদিও অভিভাবকদের কাছে এই খেলাগুলো খানিকটা বাজে এবং বিপজ্জনক খেলা হিসেবে মনে হতো।


আধুনিক ও ডিজিটাল যুগে এসে হারিয়ে গিয়েছে এসব খেলা। যেখানে শারীরিক শ্রমের মাধ্যমে এই খেলাগুলো শিশু কিশোরদের নানান কাজের প্রতি উৎসাহের যোগান দিত, সেখানে এসব খেলা আজ কম্পিউটার গেমস, ইন্টারনেটের মতো আধুনিক ডিভাইসের কাছে হার মেনেছে। আজকালকার যুগের শিশুরা ইন্টারনেটে ফেসবুকসহ আসক্ত হয়ে পড়ছে নানান প্রযুক্তির প্রতি। ফলে শারীরিক শ্রমের মতো বিনোদনগুলো ঠাঁই পাচ্ছেনা আধুনিক সমাজে। ফলে বর্তমান প্রজন্মের যথাযথ মানসিক বিকাশ ঘটছে না। বাড়ছে নানান ধরণের রোগব্যধির সংখ্যা। তাই বর্তমান প্রজন্মের স্বার্থেই গ্রামীণ খেলাধুলাগুলো ফিরিয়ে এনে তাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোর সাথে। আগামী প্রজন্মের চোখে থাকুক মুক্ত আকাশ, নিঃশ্বাসে থাকুক বিশুদ্ধ বাতাস, বিনোদনে থাকুক আমাদেরই ঐতিহ্যগুলো- এমনটাই এখন সময়ের প্রত্যাশা।

"উৎসব"- বাঙালির শেকড়ের সাথে গাঁথা



উৎসব শব্দটির মধ্যেই কেমন যেন একটা আনন্দ আর তৃপ্তি লুকিয়ে থাকে। প্রতিদিন আমরা মূলত নিজ ও নিজের একান্ত আপনজনের জন্যে বাঁচি। কিন্তু উৎসবের সময়ে আমরা বাঁচি সকলের হয়ে সকলের মধ্যে। মিলতে চাই সকলের সাথে। এর মধ্যেই উৎসবের স্বার্থকতা নিহিত। মিলনের তাগিদ থেকেই মানব সমাজে উৎসবের এত রমরমা।
কথায় আছে, বাঙালির বারো মাসে তের পার্বণ। অর্থাৎ বাঙালির প্রকৃতির মধ্যেই একটা উৎসবের আঁচ পাওয়া যায়। বাংলার রয়েছে উৎসবের ইতিহাস। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় নানান ধরণের উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এবং জাতি হিসেবে উৎসব নিয়ে আছে গর্ব করার মতো ইতিহাস। নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষের এই বাংলায় রয়েছে নানান ধর্মীয় উৎসব, রয়েছে পহেলা বৈশাখ, নবান্ন উৎসব, পিঠা উৎসব, চৈত্র সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি। এছাড়াও আদিবাসী গোষ্ঠীরা বিজু, বৈসাবিসহ পালন করে আসছে নানা ধরণের উৎসব। কয়েক ধরণের উৎসব সম্পর্কে কিছু আলোচনা করবো।

ধর্মীয় উৎসবসমূহ: যদিও বলা হয়ে থাকে বাংলার মানুষের সাথে উৎসব ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আর উৎসবের মূল স্বার্থকতা নিহিত থাকে মিলনের মধ্যেই। কিন্তু বাঙালির জাতিগত ইতিহাস কিছুটা ভিন্ন কথা বলে। প্রশ্ন রয়ে যায় যে, আমাদের উৎসব পার্বণগুলি কি সকল বাঙালিকে নিয়েই? নাকি বিশেষ কোন গোষ্ঠীকে নিয়ে? বাংলার ইতিহাস বর্ণভেদের ইতিহাস। বস্তুত সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রেই কথাটি সত্য। বাংলায় বারো মাসে তের পার্বণ। কিন্তু সেই পার্বণগুলোর ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে সবকিছুরই উৎপত্তি বর্ণভেদের সংস্কৃতি থেকে। এই বর্ণভেদই আবহমান বাংলার সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি।  গোষ্ঠীবদ্ধ শ্রেণীবিভক্ত সমাজ চেতনায় খণ্ডিত উৎসবে। সাম্প্রদায়িক ধর্মের পরিসরে যা মান্যতা পেয়ে যায় জাতীয় জীবনে। আর সেখানেই মানুষে মানুষে মিলনের বদলে গড়ে উঠতে থাকে এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর, গোষ্ঠীবদ্ধ শ্রেণীবিভক্ত সাম্প্রদায়িক মানসিকতা। তার ফলে বাঙালির জাতীয় উৎসব নিয়ে আজো প্রশ্ন রয়ে যায়।
বাংলা অঞ্চল বলতে মূলত আমাদের বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গকেই বুঝায়। এপার বাংলা এবং ওপার বাংলা, দুই বাংলাতেই সংস্কৃতি, ভাষাসহ অনেকাংশেই মিল রয়েছে। আর ধর্মীয় উৎসবের কথা উল্লেখ করতে গেলে ওপার বাংলা তথা পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আধিক্য থাকার কারণে দেখা যায় বাঙালি হিসেবে ধর্মীয় উৎসব পালনে তারা শারদীয় দূর্গোৎসবকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। আবার এপার বাংলা, তথা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণে ঈদুল ফিতরকে প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে শারদীয় দূর্গোৎসবের ক্ষেত্রে একথা সত্য যে, এটি বাংলার একান্তই নিজস্ব সংস্কৃতির পরিচয়বাহী। এক এক সম্প্রদায়, এক এক গোষ্ঠী, এক এক শ্রেণীর বাঙালি চেতনায় বাঙালির সংস্কৃতির পরিচয় ভিন্ন। আর সেই কারণেই বাংলায় হিন্দুর সংস্কৃতি, মুসলিমের সংস্কৃতি, উচ্চবর্ণের সংস্কৃতি, ধনীর সংস্কৃতি, নির্ধনের সংস্কৃতি প্রত্যেকটি পরস্পর ভিন্ন।
বাংলায় ইসলামের প্রসারের আগেও সেভাবে জাতীয় উৎসবের কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। পাল আমলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারকাল ছাড়াও তৎকালীন হিন্দু সমাজে বর্ণপ্রথা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো। পরবর্তীতে নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মাঝে ব্যাপকভাবে ইসলামের প্রসারে বাংলার সমাজে সাম্প্রদায়িক বিভাজন আরোও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে পরস্পরের মিলন আরোও দুরূহ হয়ে উঠলো আরো সহজেই। তবে সব উৎসবেই বর্ণভেদের বিষয়টা হয়ে উঠে স্পষ্ট। আর এই বিভাজন সৃষ্টি হয়েছিলো মূলত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উঁচু নিচুর মাপকাঠিতে।
তবে বর্তমানে বাংলায় ধর্মীয় উৎসবগুলো পালিত হয় ভেদাভেদের দেয়ালকে ভেঙ্গেই। সময়ের সাথে সাথে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন এসেছে বলেই এখানে ঈদ, পূজা, বৌদ্ধ পূর্নিমা, বড়দিন ইত্যাদি উৎসবগুলো পালিত হয়ে আসছে সকলকে কাছে টেনে নেয়ার উদ্দেশ্যকে ঘিরেই।


পহেলা বৈশাখ: বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটিকে বছরের প্রথম দিন হিসেবে পহেলা বৈশাখ নামে পালন করা হয়। একে নববর্ষ হিসেবে এপার এবং ওপার দুই বাংলাতেই অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপন করা হয়। বাংলাদেশে নববর্ষের ঐতিহ্য হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এই শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কো ২০১৬ সালে “মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে ঘোষণা করা করে।
একসময় নববর্ষ পালিত হতো আর্তব উৎসব বা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। তখন এর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো কৃষির, কারণ কৃষিকাজ ছিলো ঋতুনির্ভর। এই কৃষিকাজের সুবিধার্থেই মোঘল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০/১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয় তাঁর সিংহাসনে আরোহনের সময় থেকে। হিজরি চান্দ্রসন এবং বাংলা সৌরসনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। নতুন সনটিকে প্রথমে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচয় দেয়া হয়। পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়।
বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত আকবরের সময় থেকেই। সে সময়ে বাংলার কৃষকেরা চৈত্র মাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূস্বামীদের খাজনা পরিশোধ করতো। পরদিন নববর্ষে ভূস্বামীরা তাদেরকে মিষ্টিমুখ করাতো। এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।  ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় এবং উৎসবমূখী হয়ে ওঠে। এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে। অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিলো হালখাতা, যেটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। এদিনে গ্রামেগঞ্জে ব্যবসায়ীরা তাদের নতুন হিসেবের খাতা খুলতেন। চিরাচরিত এই অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়।
বাংলা নববর্ষ ও চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে তিন পার্বত্য জেলায় আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয়-সামাজিক অনুষ্ঠান ‘বৈসাবি’ আনন্দমূখর পরিবেশে পালিত হয়। বৈসাবি হলো পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় উৎসব। চাকমারা একে বিজু এবং মারমারা সাংগ্রাই হিসেবে পালন করে থাকে।


নবান্ন উৎসব : নবান্ন পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয় তার মধ্যে নবান্ন অন্যতম। “নবান্ন” শব্দের অর্থ “নতুন অন্ন”। নবান্ন উৎসব হলো নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষ্যে আয়োজিত উৎসব। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
হিন্দু রীতিতে নবান্ন একটি পূজাও বটে। নবান্ন উৎসব হিন্দুদের একটি প্রাচীন প্রথা। ১৯৯৮ সন থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উৎসব পালন শুরু হয়েছে। এটি বাংলার মানুষের কাছে একটি অতি আপন সংস্কৃতি যা বাঙালি মননের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

পোশাকে-আশাকে বাঙালির ঐতিহ্য

আমরা যখন কোনো বাঙালি নারীর কথা চিন্তা করি, তখনই আমাদের সামনে যে অবয়বটি ফুটে উঠে, সেটি হলো শাড়ি পরা এক নারীর চিত্র। রকমারি মুখরোচক খাবার...